কক্সবাজারের এক ল্যাবের দক্ষতা নেই চট্টগ্রামের পাঁচ ল্যাবের!


চট্টগ্রামে করোনাভাইরাস শনাক্তে বিদ্যমান পরীক্ষাগার রয়েছে পাঁচটি। এই পাঁচ ল্যাবে দৈনিক গড়ে ৬শ’র মতো নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। অথচ, প্রায় একই জনবল দিয়ে কক্সবাজারের ল্যাবে দৈনিক গড়ে ৫শ নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে নিয়মিতভাবে।

জেলা শহর কক্সবাজারের একটি ল্যাব যদি গড়ে ৫শ নমুনা পরীক্ষা করার মতো সামর্থ্য রাখতে পারে তাহলে বিভাগীয় শহর চট্টগ্রামের পাঁচটি ল্যাব অন্ততঃ তাদের সমসংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করতে কেন পারছে না, সেটা নিয়ে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ স্বাস্থ্য বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ।

মজার ব্যাপার হল, চট্টগ্রামের ল্যাবগুলো পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্তরা ল্যাব চালুর আগে দৈনিক তিনশ’ থেকে পাঁচশ’ নমুনা পরীক্ষার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তিন মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এসব ল্যাব কর্র্তৃপক্ষ তাদের কর্মদক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেনি। আগামীতে পারবে, এমন লক্ষণও কার্যত দেখা যাচ্ছে না।

এ অদক্ষতার কারণে চট্টগ্রামের রোগীরা নমুনা দিয়ে ১০/১১ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেও পাচ্ছেন না তাদের ফলাফল। এমনও হচ্ছে, ফল আসার আগেই কেউ মারা যাচ্ছেন, আবার সৌভাগ্যবানরা সুস্থ হওয়ার পর্যায়ের পৌঁছে যাচ্ছেন।

স্বাস্থ্য বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এমন পরিস্থিতিতে রীতিমতো বিব্রত বোধ করছেন। চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে এমন অবহেলায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরের নাগরিকরা ক্ষোভে ফুঁসছেন। তারা সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেছেন, চট্টগ্রামবাসীকে একটু শ্বাস নেয়ার ব্যবস্থা করে দিন। মানুষের জীবন নিয়ে যারা খেলার চেষ্টা করছেন, তাদের চিহ্নিত করুন। ল্যাবগুলোর কর্মদক্ষতা চট্টগ্রাম উপযোগী করুন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১ এপ্রিল মাত্র একটি পিসিআর মেশিন দিয়ে নমুনা পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ। যদিও পরবর্তীতে সেখানে আরও একটি পিসিআর মেশিন যোগ হয়। বর্তমানে সেখানে তিন শিফটে ১৫ জন চিকিৎসক ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করে থাকেন। প্রতি শিফটে একটি পিসিআর মেশিনে ৯৬ টি করে দুইটিতে ৫৭৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এরবইরেও আরও কিছু নমুনা পরীক্ষা করতে হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে কিট পরিমাণ ও মেশিন বাড়ানো গেলে নমুনা পরীক্ষার পরিমাণও আরও বৃদ্ধি করতে চায় বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. অনুপম বড়ুয়া।

আলাপকালে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক-টেকনোলজিস্টসহ ১৫ জন হলেও তাদের মধ্যে ইতোমধ্যে দুইজন করোনায় আক্রান্ত। বাকিরাই কাজ করে যাচ্ছেন। তবে সবাই কাজে আন্তরিক বলেই এত সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করা যাচ্ছে। শুরু থেকেই আমাদের কিট নিয়ে সমস্যায় আছি। তবে সঠিক সময়ে যদি কিট সরবরাহ করা হয়, তাহলে প্রতিদিন একহাজার নমুনা পরীক্ষার কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।’

‘চট্টগ্রামে নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে পরামর্শ দিয়ে এ কলেজ অধ্যক্ষ আরও বলেন, করোনার এই মহামারিতে আমরা যুদ্ধে নেমেছি, এমনটাই সকলকে চিন্তা করতে হবে। সরকারি চাকরি করি বলে টাইম টু টাইম এসে চলে না গিয়ে, অন্তত এ সময়ে নিজের দায়বদ্ধতা থেকে হলেও কিছুটা সময় কাজে সময় বাড়ি দেয়া উচিত। দেশের এই ক্লান্তিকাল সময়ে কিছু না করতে পারলে তার জন্য নিজেরাই দায়ী বলেও মন্তব্য করেন তিনি।’

চট্টগ্রামের ল্যাব সংশ্লিষ্ট তথ্য জানা যায়, প্রতিদিন চট্টগ্রামে পরীক্ষা হওয়া নমুনার এক তৃতীয়াংশই পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ করে থাকে ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি ল্যাব কর্তৃপক্ষ। চালু হওয়ার পর বেশ কিছুদিন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ^বিদ্যালয় (সিভাসু) কর্তৃপক্ষ দুইশ’ অধিক নমুনা পরীক্ষা করে আসলেও, পরবর্তীতে তা কমে একশ’ থেকে দেড়’শতে আসে। একই চিত্র ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ল্যাবেও। যদিও সর্বশেষ কয়েকদিন এ ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার পরিমান দুইশ’ ছাড়িয়েছে। তবে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের চেয়ে তাদের বেশি জনবল ও সক্ষমতা আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

ল্যাব কর্তৃপক্ষ সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষার কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা দাবি করলেও সূত্র জানায়, দুপুর আড়াইটার মধ্যেই তাদের ল্যাবটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। যদিও বিষয়টি মানতে নারাজ ল্যাব ইনচার্জ ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা. আহসানুল হক কাজল।

তিনি বলেন, ‘সকাল আটটা থেকে আমাদের পরীক্ষার কাজ বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলে। এরপর রিপোর্ট তৈরি ও অন্যান্য কাজ করা হয়। সব কিছু শেষ করতে নয়টা থেকে দশটাও লেগে যায়।’ কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের তথ্য দেয়ার পর তিনি বলেন, ‘আমাদেরও পরীক্ষার পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব। তবে জনবল সংকট আছে। তা নিরসন করা গেলে পরীক্ষার পরিমাণও বৃদ্ধি করা যাবে।’

কতজন জনবল নিয়ে ল্যাবটি পরিচালনা করা হচ্ছে, বাড়াতে গিয়ে সমস্যা কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক-টেকনোলজিস্টসহ ২০ থেকে ২৫ জন জনবল আছে। কিন্তু সঠিক সময়ে টেকনোলজিস্ট না পাওয়ার কারণেই এটি সম্ভব হচ্ছে না। তারা যদি এ বিষয়ে আন্তুরিক হয় তাহলে তা বৃদ্ধি করা যাবে।’

শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ল্যাবে চিত্রই নয়। এমন চিত্র রয়েছে সিভাসু ল্যাবেও। ওই ল্যাবটিতেও পরীক্ষার পরিমাণ বাড়ানোর সক্ষমতা আছে। সম্প্রতি সিভাসুর উপাচার্য পূর্বকোণের সাথে আলাপকালে তিনি নিজেই দাবি করেছেন, চট্টগ্রামে কেউ যদি ল্যাব তৈরি করতে চায়, সিভাসু সহযোগিতা করবে। তাদের যথেষ্ট জনবল রয়েছে। কিন্তু ওই ল্যাবেই বর্তমানে এক শিফটে কাজ শেষ করেন তারা। তবে এ দুটি ল্যাব থেকে কিছুটা ভিন্ন ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি। সেখানে স্বল্প জনবল নিয়েই করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু থেকে গড়ে আড়াইশ’র অধিক নমুনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

এমন পরিস্থিতি দ্রুত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ল্যাবগুলোতে নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ বাড়ানোর কথা জানিয়ে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন পূর্বকোণকে বলেন, ‘করোনার এ মহামারি সময়ে শুধু যে সাধারণ মানুষের আক্রান্ত হচ্ছে, তা নয়।
বরং চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছে। তাদেরও মৃত্যুর সংখ্যা কম নয়। তাই দেশের ও নিজেদের স্বার্থে হলেও সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা আরও বাড়িয়ে দেয়া উচিত। পরীক্ষার পরিমাণ যদি না বাড়ে, তাহলে এ ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব হবে না।’/সূত্র- পূর্বকোণ